১৯৪৭ সালের পুর্বে ভারতীয় উপমহাদেশের 'বেঙ্গল' ছিল বর্তমানের বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। প্রায় ৮০,০০০ বর্গমাইল বিশাল ভূখণ্ড ছিল এই বাংলা। ইংরেজদের ‘বেঙ্গল’ অন্যান্য ইয়োরোপীয়দের (বিশেষ করে পর্তুগীজদের) ‘বেঙ্গালা’ থেকেই নেওয়া হয়েছে। এই নামটিই তারা আধিপত্য বিস্তারের সময় পেয়েছিলেন বা, এই ভূভাগ ইয়োরোপীয়দের কাছে এই নামেই পরিচিত ছিল।
ষোল ও সতেরো শতকে ইয়োরোপীয়দের লেখনীতে ‘বেঙ্গালা’ নামে দেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। সীজার ফ্রেডারিক ‘বেঙ্গালা’ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত চাটিগানের ১২০ মাইল দূরে অবস্তিত ‘সোন্দিব’ দ্বীপের উল্লেখ করেছেন। ডুজারিক প্রায় ২০০ লীগ উপকূল বিশিষ্ট ‘বেঙ্গালা’ দেশের উল্লেখ করেছেন। র্যালফ ফিচ্ (১৫৮৬)’বেঙ্গালা’ দেশে ‘চাটিগান’, ‘সতগাম’ (সপ্তগ্রাম), ‘হুগেলি’ (হুগলী) এবং ‘তাণ্ডা’ (রাজমহলের নিকটবর্তী) শহরের উল্লেখ করেছেন। পূর্ববর্তী ইয়োরোপীয় ভ্রমনকারীরা ‘বেঙ্গালা/বেঙ্গেলা/বাঙ্গালা’ রাজ্য ও ঐ নামের একটি শহরের কথা উল্লেখ করেছেন। রেনেল এই নামের শহরের কথা উল্লেখ করেছেন কিন্তু এর অবস্থিতি সম্পর্কে নিঃসন্দেহ ছিলেন না। গ্যাস্টলদি তাঁর মানচিত্রে চাটিগামের পশ্চিমে ‘বেঙ্গালা’র অবস্থিতি দেখিয়েছেন। ‘বেঙ্গালা’ শহরের অবস্থিতি সম্পর্কে পণ্ডিতবর্গের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও ‘বেঙ্গালা’ রাজ্য যে বাংলা’দেশ অঞ্চলকে বোঝাতো সে বিষয় কোন সন্দেহ নেই।
মোগল আমলে এই ভূ-ভাগই ‘সুবা বাঙ্গালা’ বলে চিহ্নিত হয়েছিল। আবুল ফজল এই প্রদেশের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন যে, বাঙ্গালা পূর্ব-পশ্চিমে অর্থাৎ চট্টগ্রাম থেকে তেলিয়াগড় পর্যন্ত ৪০০ ক্রোশ এবং উত্তর-দক্ষিণে, অর্থাৎ উত্তরে পর্বতমালা হতে দক্ষিণে হুগলি জেলার মন্দারণ পর্যন্ত ২০০ ক্রোশ বিস্তৃত ছিল। এই ‘সুবা’ পূর্বে ও উত্তরে পর্বতবেষ্টিত এবং দক্ষিণে সমুদ্রবেষ্টিত ছিল। এর পশ্চিমে সুবা বিহার। কামরূপ ও আসাম সুবা বাঙ্গালার সীমান্তে অবস্থিত ছিল। আবুল ফজল ‘বাঙ্গালাহ’ নামের ব্যাখ্যা দিয়েছেনঃ ‘বাঙ্গালাহ’র আদি নাম ছিল ‘বঙ্গ’। প্রাচীনকালে এখানকার রাজারা ১০ গজ উঁচু ও ২০ গজ বিস্তৃত প্রকাণ্ড ‘আল্’ নির্মাণ করতেন; এই থেকেই ‘বাঙ্গাল’ বা ‘বঙ্গালাহ’ নামের উৎপত্তি। অবশ্য আবুল ফজলের এই ব্যাখ্যা সবাই স্বীকার করে নেননি। রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, প্রাচীনকাল হতে ‘বঙ্গ’ এবং ‘বঙ্গাল’ দুটি পৃথক দেশ ছিল। ‘বঙ্গাল’ দেশের নাম হতেই কালক্রমে সমগ্র দেশের ‘বাংলা’ নামকরণ হয়েছে। বর্তমান কালে বাংলাদেশের আদিবাসীদের যে ‘বাঙ্গাল’ নামে অভিহিত করা হয়, তা সেই প্রাচীন ‘বঙ্গাল’ দেশের স্মৃতিই বহন করছে।
রমেশচন্দ্র মজুমদারের অনুমানও যে নিঃসন্দেহ নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলার প্রাচীন জনপদসমূহের মধ্যে ‘বঙ্গাল’ এর তুলনায় ‘বঙ্গ’ অধিক খ্যাতিমান ও গুরুত্যপূর্ণ ছিল সেই বিষয় কোন সন্দেহ নেই এবং ‘বঙ্গ’ জনপদের মধ্যেই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার অনেক ভৌগলিক সত্তাই অন্তর্ভুক্ত ছিল (এর মধ্যে ছিল বঙ্গাল,সমতট,চন্দ্রদ্বীপ এমনকি সম্ভবত হরিকেল)। তাই ‘বঙ্গ’ থেকে না ‘বঙ্গাল’ থেকে সারা দেশের নাম ‘বাঙ্গালা’ হয়েছে এই বিষয় সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্ত করা সম্ভব নয়। নীহাররঞ্জন রায় অবশ্য আবুল ফজলের ব্যাখ্যাকে একেবারে অযৌক্তিক মনে করেননি। নদিমাতৃক বারিবহুল দেশে বন্যা ও জোয়ারের রোধের জন্য ছোট বড় বাঁধ (আল) নির্মাণ কৃষি ও বাস্তুভূমির যথার্থ পরিপালনের পক্ষে অনিবার্য। সুতরাং ‘বঙ্গ’ এর সঙ্গে ‘আল’ যুক্ত হয়ে ‘বঙ্গাল’ বা ‘বাঙ্গাল’ বা ‘বাঙ্গালা’ নামকরণ খানিকটা যুক্তিসম্মত।
মোগলপূর্ব ‘বাঙ্গালা’ সমস্ত ভূখন্ডের নাম সূচনা করতো কি? এই প্রশ্নের উত্তরে দেখা যায় যে, বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বাংলা বিজয়ের সময় ‘বাঙ্গালা’ নামে একক কোন দেশ ছিল না। ঐতিহাসিক সিরাজ-ই-মিনহাজ মুসলমানদের বাংলা বিজয়ের ইতিহাস রচনার সময় ‘বাঙ্গালা’ নামের উল্লেখ করেননি; বরং বরেন্দ্র, রাঢ় এবং বঙ্গ নামে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলকে চিহ্নিত করেন। মিনহাজের বর্ণনায় বাংলা সম্বন্দ্বে তাঁর ভৌগলিক জ্ঞানের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি লখনৌতি ও বঙ্গকে পৃথকভাবে উল্লেখ করেছেন এবং যথাক্রমে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলা এবং পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব বাংলাকে বুঝিয়েছেন। বঙ্গের সাথে সমতট (সকনত)- এর উল্লেখও তিনি করেছেন।
মিনহাজের পরবর্তী ঐতিহাসিক জিয়া-উদ-দিন বারনী সর্বপ্রথম ‘বাঙ্গালা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন , কিন্তু সমগ্র দেশ নয়, এক অংশ বিশেষের উল্লেখ প্রসঙ্গে। পরবর্তী ঐতিহাসিক শামস-ই সিরাজ আফীফ সুলতান শামস্-উদ্দ-দীন ইলিয়াস শাহ্কে ‘শাহ্-ই-বাঙ্গালা’ ‘শাহ্-ই-বাঙ্গালিয়ান’ বা ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালা’ রূপে আখ্যা দিয়েছেন। সুলতান ইলিয়াস শাহ্ সমস্ত বাংলায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। তাঁর পূর্বে অন্য কোন মুসলমান শাসক দীর্ঘকাল বাংলার সমগ্র ভূখণ্ড শাসন করেছেন একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। ইলিয়াস শাহ বাংলার তিনটি শাসনকেন্দ্রেই (লখনৌতি, সাতগাঁও, ও সোনারগাঁও) নিজ আধিপত্য বিস্তার করেন এবং বাংলায় স্বাধীন সুলতানির প্রকৃত ভিত্তি স্থাপন করেন। এই স্বাধীনতা প্রায় দু’শো বছর ধরে অক্ষুণ্ণ ছিল। তাই ইলিয়াস শাহ্ মুসলমান সুলতানদের মধ্যে প্রকৃত অর্থেই প্রথম ‘শাহ্-ই-বাঙ্গালা’ বা ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালা’।
সুতরাং একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, আফীফ ‘বাঙ্গালা’ বলতে সারা বাংলাকে অর্থাৎ আবুল ফজলের ‘বাঙ্গালা’ বা ইয়োরোপীয়দের ‘বেঙ্গালা’, ‘বেঙ্গল’ –কে বুঝিয়েছেন। তাই ইলিয়াস শাহের সময় থেকেই প্রথম তাঁর ‘বাঙ্গালা’ অর্থে ব্যবহিত হয়েছে। এর আগে, এমনকি মুসলমান-পুর্ব যুগে, এই ব্যাপক অর্থে ‘বাংলা’ বা ‘বাঙ্গালা’র ব্যাবহার পাওয়া যায় না। ঐ সময়ে ‘বঙ্গ’ বা ‘বঙ্গাল’ বাংলার অংশবিশেষকে নির্দেশ করা হতো।
তাই ‘বাঙ্গালা’ নামের প্রচলন ইলিয়াস শাহ্-এর সময় থেকেই শুরু হয়েছে একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে।
সুকুমার সেন ‘বঙ্গ’ থেকে ‘বাঙ্গালা’ বা ‘বাঙ্গালাহ্’র উৎপত্তি হয়েছে, ‘বাঙ্গালা’ নামটি অধিকারকালে সৃষ্ট এবং ফারসি ‘বাঙ্গালাহ’ থেকে পর্তুগীজ ‘বেঙ্গালা’ ও ইংরেজি বেঙ্গল এসেছে বলে মত প্রকাশ করেন।
বাংলা বা বেঙ্গল শব্দগুলির আদি উৎস: উক্ত শব্দটি বং অথবা বাং নামক একটি দ্রাবিড়ীয়-ভাষী উপজাতি বা গোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
দ্রাবিড়ীয় জাতি দক্ষিণ ভারত থেকে বঙ্গে প্রবেশ করেছিলেন। অন্য তত্ত্ব বলছে যে শব্দটির উৎপত্তি ভাঙ্গা (বঙ্গ) শব্দ থেকে হয়েছে, যেটি অস্ট্রীয় শব্দ "বঙ্গা" থেকে এসেছিল, অর্থাৎ অংশুমালী। আদ্য-অস্ট্রালয়ডেরা বঙ্গের প্রথম অধিবাসী।
তথ্য
সুত্রঃ
বাংলাদেশের
ইতিহাস – ডঃ সিরাজুল ইসলাম, ডঃ মুহম্মদ আবদুর রহিম, ডঃ আবদুল মমিন চৌধুরী, ডঃ এ. বি. এম. মাহমুদ
বাংলা শব্দের ক্রমবর্ধমান রুপ পর্যায় ক্রমে যে ধারাবাহিকতা দেখানো হয়েছে তাতে বোঝা যায় যে বহু পূর্বেই বেংলা বা বাঙলা শব্দটির প্রচলন ছিল।
ReplyDelete